Wednesday, October 30, 2019

অবস্থান সম্পাদনা
রাজশাহী জেলা শহর হতে ৩০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিম কোণে বরেন্দ্র ভূমিতে অবস্থিত। তানোর উপজেলার উত্তরে নওগাঁ জেলার নিয়ামতপুর উপজেলা ও মান্দা উপজেলা, পূর্বে রাজশাহী জেলার মোহনপুর উপজেলা , দক্ষিণে রাজশাহী জেলার পবা উপজেলা ও গোদাগাড়ী উপজেলা এবং পশ্চিমে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলা ও নাচোল উপজেলা অবস্থিত। তানোরের পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে শিব নদী ।


বুরুজ ব্রিজের উপর থেকে তোলা শিব নদীর একাংশ
যোগাযোগ সম্পাদনা
সড়ক পথে- ঢাকা থেকে ঢাকা-রাজশাহী জাতীয় মহাসড়ক পথে রাজশাহী জেলা শহর প্রায় ২৭০ কি. মি. রাজশাহী - তানোর সড়কে রাজশাহী বাসস্ট্যান্ড হতে তানোর উপজেলা পরিষদ প্রায় ৩০ কি. মি.। রাজশাহী থেকে রাজশাহী-নঁওগা জাতীয় মহাসড়ক পথে ১০ কি.মি. বায়া নামক স্থান হয়ে আমনুরা রাস্তায় ২০ কি.মি. এলে তানোর গোল্লা পাড়া বাজার বা তানোর থানা মোড়ে নেমে তালন্দ সড়কে ১ কি. মি. এলে তানোর উপজেলা পরিষদ এর চত্বর। নদী পথে- শিব নদী পথে তানোর উপজেলায় মালামাল পরিবহন করা যায়। তবে রেল পথে তানোর উপজেলা পরিষদ এর সাথে কোনো যোগাযোগ নাই। তানোরের মোট পাকা রাস্তা ২১৬ কি.মি., আধা পাকা রাস্তা ৫১ কি.মি., কাঁচা রাস্তা ৪২৭ কি.মি.।

প্রশাসনিক এলাকা সম্পাদনা
তানোর উপজেলা মোট ২ টি পৌরসভা, ৭ টি ইউনিয়ন, মৌজা ২১১ এবং ১৬৯ টি গ্রাম এর সমন্বয়ে গঠিত। তানোরের ইউনিয়ন সমূহ হলো -

কলমা ইউনিয়ন
বাধাইড় ইউনিয়ন
পাঁচন্দর ইউনিয়ন
সরনজাই ইউনিয়ন
তালন্দ ইউনিয়ন
কামারগাঁ ইউনিয়ন
চাঁন্দুড়িয়া ইউনিয়ন
দুটি পৌরসভা হলো-

তানোর পৌরসভা
মুণ্ডুমালা পৌরসভা
ইতিহাস সম্পাদনা
রাজশাহী জেলার উত্তর-পশ্চিম কোণে জেলা শহর থেকে ৩০ কি. মি. দূরে শিবনদী এবং বিলকুমারীর পশ্চিমপাড়ে বরেন্দ্রভূমির প্রাণকেন্দ্রে তানোর উপজেলা । ‘তানোর ’ শব্দটি তানর হতে উদ্ভূত । ‘ তানর ’ অর্থ তান-রহিত অর্থাৎ জীবন-স্পন্দনহীন, নিস্প্রভ ও নিরানন্দ জনপদ। পুরাকালে গাছপালাহীন মরুপ্রায় এ অঞ্চলে জনপদ বলতে তেমন কিছুই ছিল না । কালের আবর্তে ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে আজকের এ জনপদ ‘তানোর ’ যা একটি শস্যশ্যামল খাদ্য ভান্ডার বিশেষ । এখানে অনেকগুলো আদিবাসী গ্রাম রয়েছে এবং তারা এখানে স্বাচ্ছন্দ্যে বসবাস করে। তানোরে অনেক প্রাচীন কাল থেকে সাঁওতাল আদিবাসী গোত্রের জনগণ বাস করে।

মুক্তিযুদ্ধে তানোর সম্পাদনা
তানোর উপজেলা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাত থেকে মুক্তি পায় ১৯৭১ সালের ৩০ শে নভেম্বর। ২৯ শে নভেম্বর রাতে এখানে সর্বশেষ যুদ্ধ হয়। মুক্তিযোদ্ধা গেরিলা বাহিনীর নেতৃত্ব দেন সফিকুর রহমান রাজা যিনি ঐ সময় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স শেষ বর্ষের ছাত্র ছিলেন। ২৯ শে নভেম্বর তানোর বুরুজ গ্রামের বুরুজ ঘাট এলাকায় এসে ছয়জন মুক্তিযোদ্ধা রাজাকারদের সহযোগিতায় পাক বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। তাদেরকে তানোর থানা টর্চার সেলে নিয়ে নির্যাতন চালানো হচ্ছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের মুক্ত করতে সেই দিনই তানোর থানায় হামলা চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। [৩] ২৯শে নভেম্বর রাতে সফিকুর রহমান রাজার নেতৃত্বে ৩০-৩৫ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল চার ভাগে বিভক্ত হয়ে তানোর থানায় অতর্কিত হামলা চালায়। প্রবল আক্রমণের মুখে পাক বাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়। তারা থানার বন্দীদশা থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের মুক্ত করেন। এই যুদ্ধে তিনজন মুক্তিযোদ্ধা শাহাদাত বরণ করেন, সিরাজুল ইসলাম ওরফে হানিফ মৃধা নামে আরেকজন মুক্তিযোদ্ধা গুরুতর আহত হলেও বেঁচে যান। শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন রাজশাহী পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটের ছাত্র মোনায়েম মঞ্জুর, কাটাখালীর মাসকাটাদিঘী বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্র মোঃ ইসলাম ও আরেকজন নাম না জানা আদিবাসী যুবক। ঐ দিনের পর তানোর থানা থেকে সেনাবাহিনী ও পুলিশ সরিয়ে নেয়া হয় এবং এই এলাকা কার্যত মুক্ত হয়। ১৭ই ডিসেম্বর সফিকুর রহমান রাজা তানোরে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। তানোরের গোল্লাপাড়া বাজারের কাছে অবস্থিত বধ্যভূমি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বহন করছে।[৪]

উপজেলার ঐতিহ্য সম্পাদনা
এ উপজেলার প্রাচীন ঐতিহ্যের মধ্যে বৌদ্ধ সভ্যতার নিদর্শন বিহারৈল ঢিবি, কুঠিপাড়ার নীলকুঠি, মাদারীপুরের পাগলা শাহ’র মাজার ও ধানোরা ঢিবি,সিঁধাইড়ের সুলতানী আমলের মসজিদ ও মাজার, গোল্লাপাড়ার বধ্যভূমি উল্লেখ্যযোগ্য। এছাড়া তানোর এ কে সরকার ডিগ্রি কলেজের শহীদ মিনার আজও স্বাধীনতা যুদ্ধের স্মৃতি বহন করে চলেছে। উচুঁ নিচু স্তরীভূত বরেন্দ্রভূমির ভূ-প্রকৃতির মাঝে বাঙালি হিন্দু-মুসলমানের সাথে সাঁওতাল, ওঁরাও , মাহাতো, মাহালী আদিবাসী সম্প্রদায়ের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক অপূর্ব মিলনস্থল এ উপজেলা।

জনসংখ্যার উপাত্ত সম্পাদনা
২০১১ সালের আদমশুমারী অনুযায়ী মোট জনসংখ্যা ১,৯১,৩৩০ জন। পুরুষ ৯৪,০৪১ জন (৪৯.১৫ %) ও মহিলা ৯৭,২৮৯ জন(৫০.৮৫ %) । জনসংখ্যার ঘনত্ব ৬৪৮ প্রতি বর্গ কি.মি. । মুসলমান ১,৬২,০১৮ জন (৮৪.৬৮%), হিন্দু ১৫,১৫২ জন (৭.৯২%), খৃস্টান ৯,৩২৯ জন (৪.৮৭%), বৌদ্ধ ১৭ জন (০.০১%), অন্যান্য ৪,৮১৪ জন (২.৫২%)। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে মসজিদ ৫১০ টি, ঈদগাহ ২০০ টি, মন্দির ২২ টি, গির্জা ১৬টি, প্যাগোডা ১টি।

শিক্ষা সম্পাদনা
শিক্ষার হার ৪৮.৮%(পুরুষ ৫১.১%, মহিলা ৪৬.৭%), প্রাথমিক বিদ্যালয় ১২৭( সরকারি ৪৯টি এবং বেসরকারি ৭৮টি), মাধ্যমিক/নিম্ন-মাধ্যমিক বিদ্যালয় ৬২, কলেজ ১৮(০২টি কারিগরি মহাবিদ্যালয়সহ), মাদরাসা ২৮।

অর্থনীতি সম্পাদনা
মোট কৃষি জমির পরিমাণ ২২,৬৬৫ হেক্টর; চাষযোগ্য কৃষি জমির পরিমাণ ২১,২৯৫ হেক্টর; বনাঞ্চল ১০০ কি.মি. (সামাজিক বনায়ন) গবাদী পশু খামার ৮৬টি, হাঁস-মুরগি খামার ৬৩টি, হাঁস-মুরগির ইউনিট ২৬টি।

প্রধান ফসল: আলু, ধান, টমেটো, গম, ভুট্টা, বেগুন, পটল ইত্যাদি। তানোর উপজেলায় সবচেয়ে ধান চাষ বেশি পরিমাণে হয়ে থাকে তাই এ অঞ্চলের মানুষের ব্যবসা-বাণিজ্য মূলত ধান নিয়েই। তানোরে আম ও কাঁঠাল সবচেয়ে বেশি উৎপাদিত হয়।